পবিত্র মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আজ আমরা তথ্যসূত্রসহ পবিত্র মাহে রমজানে সাহরী ও ইফতারের ফজিলত এবং রমজান মাসের গুরত্ব তাৎপর্য নিয়ে লিখার প্রয়াস চালাবো। ইনশা-আল্লাহ!
পবিত্র মাহে রমজানুল মুবারাক, মু’মীন বান্দার বহুল প্রতিক্ষিত একটি মাস।
কুরআন অবতীর্ণের মাস, রহমত ও কল্যাণের মাস, ভ্রাতৃত্ব সহানুভূতির চর্চার মাস। যেই মাসের আরো অনেক কল্যাণকর দিক রয়েছে, আজ আমরা কথা দীর্ঘায়িত না করে ছোট্ট পরিশরে শুধু ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতির কথা আলোচনা করবো।
সাহরী:
রোযা রাখার নিয়তে সুবহে সাদিকের পূর্বে যে খাবার গ্রহণ করা হয় তাকে সাহরী বলে।
সাহরী খাওয়ার হুকুম:
সাহরী খাওয়া সুন্নত। এবং রাতের শেষাংশে খাওয়া মুস্তাহাব। কারণ নবী কারীম (সা:) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবাইকে রাতের শেষাংশে ফজরের নামাজের সময় হওয়ার আগে (সতর্কতামূলক সময় হাতে রেখে) সাহরী খাওয়ার জন্য গুরুত্ব সহকারে বলতেন।
শেষ রাতে সাহরী খাওয়ার গুরুত্বতা:
সাহরীর গুরুত্বের ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
عن انس رضي الله عن النبي صلى الله عليه وسلم أَنَّهٌ قَالَ
تَسَحّرُوا فَإِنّ فِي السّحُورِ بَرَكَةً.
তোমরা (শেষ রাতে) সাহরী কর। কেননা সাহরীতে বরকত নিহিত আছে।
তথ্যসূত্র সনদসহ দেখুন: সহীহ বুখারী শরীফ হাদীস নং: ১৯২৩; সহীহ মুসলিম শরীফ, হাদীস নং: ১০৯৫
অর্থাৎ পার্থিব বিবেচনায় সাহরীর খাবার যেমন দিনের বেলা রোযা রাখতে সাহায্য করে শরীরে শক্তি যোগায়।
তেমনি পরকালীন বিবেচনাতেও এতে বরকত ও কল্যাণ এবং পুণ্য রয়েছে। (সাহরী ও ইফতারের ফজিলত এবং তাৎপর্য)
অন্য হাদীসে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে–
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم
اَلسُّحُوْرُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ، فَلَا تَدَعُوهُ، وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ، فَإِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ .
সাহরীর খাওয়াতে বরকত রয়েছে। অতএব তোমরা তা ছেড়ো না; যদিও এক ঢোক পানি পান করেও হোক না কেন।
কেননা যারা সাহরীর খাবার খায় আল্লাহ তা’য়ালা তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্য রহমতের দুআ করতে থাকে।
তথ্যসূত্র সনদসহ দেখুন –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং. ১১০৮৬,
এছাড়া আরো অনেক বর্ণনায় সাহরী গ্রহণকারীদের জন্য রহমতের দুআর কথা বর্ণিত হয়েছে।
সাহরী করা যেমন সুন্নাত তেমনি তা ওয়াক্তের শেষ দিকে করাও মুস্তাহাব। অর্থাৎ সতর্কতামূলক সময় হাতে রেখে সুবহে সাদিকের পূর্ব–নিকটবর্তী সময়ে সাহরী করা ভালো।
সাহরী এবং ফজরের ওয়াক্তের মাঝের সতর্কতামূলক সময়।
কোরআন মাজিদের মধ্যমধরণের ৫০ টি আয়াত পড়ার সময়টুকু হলো সাহরীর সতর্কতামূলক সময় , যাহা হিসেব করলে ৪/৫ মিনিট হয়।
٩١٧٤ – حدثنا وكيع عن هشام عن قتادة عن أنس
عن زيد بن ثابت قال : تسحرنا مع رسول اللَّه -صلى اللَّه عليه وسلم- ثم قمنا إلى الصلاة قلنا: كم كان بينهما؟ قال: قراءة خمسين آية ،
তথ্যসূত্র : সহীহ বুখারী, হাদীস নং. ১৯২১ সহীহ মুসলীম, হাদীস নং. ১০৯৭
নবী কারীম (সা.) সাহরীকে বিলম্ব করার ব্যাপারে আরো বলেন–
عمر ابن عباس رضي لله عن عنه أنَّ رسول الله صلى الله عليه وسلم قال
إِنّا مَعَاشِرَ الْأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا أَنْ نُعَجِّلَ فِطْرَنَا، وَأَنْ نُؤَخِّرَ سَحُورَنَا.
আমরা নবীগণ এ মর্মে আদিষ্ট হয়েছি যে, (সময় হওয়ার পর) ইফতারী তাড়াতাড়ি করব এবং (সময় থাকতে থাকতে) সাহরী বিলম্ব করব।
সনদসহ তথ্যসূত্র: আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ১৮৮৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৪৮৮০ সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস. ৪৭৬২
হযরত সাহাবায়ে কেরামের আমলও ছিলো বিলম্ব করে সাহরী করা এবং দ্রুত ইফতার করা। হযরত আমর ইবনে মাইমুন আলআউদী রাহ. বলেন–
عن عمرو بن ميمون الاودي رح قال
كَانَ أَصْحَابُ مُحَمّدٍ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَسْرَعَ النّاسِ إِفْطَارًا وَأَبْطَأَهُ سُحُورًا.
সাহাবায়ে কেরাম (সময় হওয়ার পর) দ্রুত ইফতার করতেন আর সাহরী (সময়ের মধ্যে) বিলম্বে করতেন।
তথ্যসূত্র অনলাইন: মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৭৫৯১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৮৯৩২
সাহরী ও ইফতারের ফজিলত এবং তাৎপর্য
সাহরী খেয়ে দিনভর রোযা রাখার পর রোযাদারের জন্য যে আনন্দময় মুহূর্তটি উপস্থিত হয় তা হচ্ছে, ইফতারির সময়।সাধ্য অনুসারে ইফতারির আয়োজন সামনে নিয়ে রোযাদার ব্যক্তি অপেক্ষায় আছে সূর্যাস্তের; আল্লাহর হুকুমের। হাতে খাবার আছে, পেটে প্রচুর ক্ষুধা। শরীর ক্লান্ত, তবুও কিছু মুখে দিচ্ছে না। কারণ এখনও আল্লাহর হুকুম হয়নি। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য! নবী করীম (সা.) বলেন–
عن أبي هريرة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال،
لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ : فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ.
রোযাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হল তার ইফতারের সময়। অপরটি হল যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে।
তথ্যসূত্র সনদসহ –সহীহ মুসলিম, হাদীস নং. ১১৫১ সুনানে নাসায়ী হাদীস নং. ২২১৫
আল্লাহ তাআলার নিকট তার রোয়াদার বান্দার এই দৃশ্যটি অত্যন্ত প্রিয়। বান্দার এ সময়কে আল্লাহ পাক বিশেষ মর্যাদা দিয়ে থাকেন।
ইফতারের সময় দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদিস সমূহ
নবীজী বলেন–
عن عبد الله ابن عمرو بن العاص رضي الله يقول، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم
إِنّ لِلصّائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ لَدَعْوَةً مَا تُرَدّ.
ইফতারের সময় রোযাদারের অন্তত একটি দুআ এমন বরাদ্দ থাকে, যা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।
অর্থাৎ কমপক্ষে একটি দুআ অবশ্যই কবুল হয়।
তথ্যসূত্র সনদসহ: সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫৩
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. ইফতারের সময় এ দুআ করতেন–
قال ابن ابي مليكة سمعت عبد الله ابن عمرو يقول إذا أفطر
اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِرَحْمَتِكَ الّتِيْ وَسِعَتْ كُلّ شَيْءٍ أَنْ تَغْفِرَ لِيْ.
হে আল্লাহ, আমি আপনার সর্বব্যাপী রহমতের ওসিলা দিয়ে (ক্ষমা) প্রার্থনা করছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।
তথ্যসূত্র সনদসহ– সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫৩ ( সাহরী ও ইফতারের ফজিলত )
এজন্য ইফতারের একটি আদব হচ্ছে, সময় হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ইফতার প্রস্তুত করে ইফতার সামনে রেখে আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জু হয়ে বসা, বেশি বেশি দুআ–দুরুদ পড়া, এবং তাওবা–ইস্তিগফার করা।
এই সময়ে ঘরের নারীরাও যেন ইফতারের আগের দুআ–ইস্তিগফারে শামিল হতে পারে এজন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা করা এবং ঘরের অন্য সদস্যগণ তাদেরকে সহায়তা করা। ইফতারের আয়োজন এক পদ কম হোক, তবুও নারীরা যেন ইফতারের আগমুহূর্তের দুআ–ইস্তিগফার থেকে মাহরূম না হয়– এদিকে সকলের সচেতন দৃষ্টি রাখা এবং সহায়তা করা কাম্য।
ইফতারের মুহূর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। এ সময়ে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য ব্যক্তিকে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দান করেন।
নবী কারীম (সা.) বলেন–
عن جابر رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم
إِنّ لِلهِ عِنْدَ كُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءَ، وَذَلِكَ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ.
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তির জন্য (জাহান্নাম থেকে) মুক্তির ফয়সালা করে থাকেন এবং এটা রমযানের প্রতি রাতে ঘটে।
তথ্যসূত্র সনদসহ –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪৩
পবিত্র রমজান মাসে নিজের আত্মীয়-স্বজন এবং অন্যান্যদের দান করার বিশেষ ফজিলত
পবিত্র রমযান মাস সৌহার্দ সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার মাস। এই সৌহার্দের একটি প্রকাশ এমন হওয়া চাই যে, আমি কেবল আমার নয়, আমার ভাইয়েরও তার খোঁজ খবর নিব।
ইসলামে মেহমানদারি এবং মেহমান আপ্যায়নের ফযীলত অনেক। আর যদি সেই আপ্যায়ন হয় রোযাদারকে ইফতার অথবা আপ্যায়নের মাধ্যমে তাহলে তা কত মহৎ হতে পারে! কতগুন বেশি সাওয়াবের অধিকার রাখে!!
রোযাদারের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা অনেক বড় সওয়াবের আমল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
عن خالد الجهيني رضي الله قال، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم
مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ، غَيْرَ أَنّهُ لاَ يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصّائِمِ شَيْئًا.
কেউ যদি কোনো রোযাদারকে ইফতার করায় তাহলে সে ওই রোযাদারের সমান সওয়াব লাভ করবে।
আর এতে ওই রোযাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না।
তথ্যসূত্র সনদসহ: জানে তিরমিযী, হাদীস নং. ৮০৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং. ১৭৪৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীস নং. ৩৩১৬, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং. ১৭০৪৪,
তাই এ মাসের মাহত্যার্জনে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের প্রতি সহমর্মিতার দৃষ্টি আরো বাড়িয়ে দেই।
সুতরাং সবাই সবার অবস্থান থেকে কল্যাণের পথে অগ্রসর হতে থাকি। খুঁজে খুঁজে পথশিশু ও আল্লাহর বান্দাদের খোঁজ খবর রাখি।
This website is very necessary of ours Muslim ummah. May Allah bless you.